বাল্যবিবাহের কারণে বাংলাদেশে বছরে ৮ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি!
এ বছরের 16 Days of Activism-এর প্রায় অর্ধেকটা পেরিয়ে গেল। ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত গোটা বিশ্ব একসাথে 16 Days of Activism পালন করে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার(Gender-based Violence) বিরুদ্ধে। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক গুলো ফ্যাক্টর এর একটি হচ্ছে বাল্যবিবাহ বা Child Marriage।
গত ২০ নভেম্বর রাজধানীর শেরে বাংলা নগর ইউনিসেফ কার্যালয়ে বেশ কিছু নতুন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বাল্যবিবাহের কারণে বাংলাদেশ প্রতিবছর হারাচ্ছে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার। দেশের ভবিষ্যৎ কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে, মানবসম্পদের শক্তি নষ্ট হচ্ছে। অথচ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকারি বিনিয়োগ এখনো আশ্চর্যজনকভাবে কম। ইউনিসেফ জানিয়েছে, বাংলাদেশ শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থায় জিডিপির মাত্র ০.০১ শতাংশ ব্যয় করে, যা তাদের ভাষায়, ‘Shockingly Low.’
ইউনিসেফ সেখানে প্রযুক্তিগত সহায়তায় বিবিএস- মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার (এমআইসিএস) সার্ভে সম্পন্ন করে । এ বছর দেশজুড়ে প্রায় ৬৩ হাজার পরিবারের উপর এই সার্ভে করা হয়েছে। সার্ভের ফলাফল ছিল হতাশাজনক। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী বর্তমানে বিবাহিত কিশোরীর হার ২০১৯ সালের ৩২.৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৫ সালে ৩৮.৯ শতাংশে পৌঁছেছে। এটি শুধু একটি সংখ্যা নয়, এটি শত শত তরুণীর থেমে যাওয়া স্বপ্নের চিত্র।
সাধারণভাবে মনে করা হয় শিক্ষার অভাবই বাল্যবিবাহের প্রধান কারণ। কিন্তু বাস্তবতা আরও জটিল। দক্ষিণ এশিয়ায় মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষায় ভর্তি হার আমাদের সবচেয়ে বেশি থাকার পরেও আমরা কেন এত বড় ব্যর্থতার মুখোমুখি? বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন ধরেই বলছেন, বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়নে জোর দিলেও মানবিক উন্নয়নে বিনিয়োগ যথেষ্ট নয়। ফলে পরিবারগুলো এখনও একই সংকটে আটকে আছে, একই অনিশ্চয়তায় এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে।
গ্রামীণ এলাকায় পরিস্থিতি আরও কঠিন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে করা গুণগত গবেষণায় (Qualitative Research) দেখা গেছে, এখনও অনেক পরিবার মনে করে মেয়ে বড় হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দেওয়াই নিরাপদ। অনেক মেয়ে অষ্টম শ্রেণি শেষ করার পর আর স্কুলে ফিরে যেতে পারে না, কারণ পরিবার মনে করে বিয়েই তাদের একমাত্র নিশ্চয়তা। দারিদ্র্য, সামাজিক চাপ এবং নিরাপত্তাহীনতার মিশ্রণে এই সিদ্ধান্ত আরও তাড়িত হয়।
এমআইসিএস ২০২৫ প্রকাশ করেছে, বাল্যবিবাহের ফলে উৎপাদনশীলতা (productivity) এবং মানব সম্ভাবনা (human potential) হারিয়ে যাচ্ছে, আর্থিক বিচারে এই ক্ষতির পরিমাণ বছরে ৭-৮ বিলিয়ন ডলারের সমান। এই ক্ষতি শুধু অর্থের নয়, এটি হারানো সম্ভাবনার, পথে থেমে যাওয়া জীবনের, আর এক প্রজন্মের অপূর্ণতার মূল্য।
প্রতি বছর বিভিন্ন উপায়ে বিভিন্ন ফোরাম-প্রোগ্রাম-রিসার্চ ইত্যাদিতে আমরা বাল্যবিবাহ নিয়ে কথা বলি। পোস্টার তৈরি হয়, প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, আলোচনাও হয়। কিন্তু 16 Days of Activism-এর মাঝপথে এসে আজ আমাদের আবারও একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় যে আমাদের এই প্রচেষ্টাগুলো কি সত্যিই পরিবর্তন আনছে, নাকি আমরা শুধু একই কথা বলেই যাচ্ছি, আর বাস্তবতা আরও কঠিন হয়ে উঠছে?
উৎস:
১. ইউনিসেফের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট
২. জাতিসংঘের ওয়েবসাইট
৩. দ্য ডেইলি স্টার
